হুদায়বিয়ার সন্ধি কি - হুদায়বিয়ার সন্ধির গুরুত্ব ও তাৎপর্য
প্রিয় পাঠক হুদাইবিয়ার সন্ধি আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর জীবনের
অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা। এই ঐতিহাসিক চুক্তিকে মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে
ফাতহুম মুবিন বা সুস্পষ্ট বিজয় বলে উল্লেখ করেছেন।
আজকে আমরা আপনাদের সামনে হুদায়বিয়ার সন্ধি কি , হুদায়বিয়ার সন্ধি কত হিজরীতে
হয়, হুদায়বিয়ার সন্ধির পটভূমি, হুদায়বিয়ার সন্ধির গুরুত্ব ও তাৎপর্য এবং
হুদায়বিয়ার সন্ধির শর্ত কতটি সে সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব।ঐতিহাসিক
হুদায়বিয়ার সন্ধি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে আমাদের পোস্টটি শেষ পর্যন্ত মনোযোগ
সহকারে পড়ার অনুরোধ রইল।
হুদায়বিয়ার সন্ধি কি - হুদায়বিয়ার সন্ধির গুরুত্ব ও তাৎপর্য
হুদায়বিয়ার সন্ধি কি
মক্কা হতে এক মাইল দূরে অবস্থিত হুদায়বিয়া একটি কুপের নাম। এ কুপের সংলগ্ন
স্থানটি হুদায়বিয়া নামেই প্রসিদ্ধ। এ ঐতিহাসিক স্থানে কুরাইশদের সাথে মহানবী
(সাঃ)-এর এক সন্ধি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল যা ইসলামের ইতিহাসে হুদায়বিয়ার সন্ধি
নামে প্রসিদ্ধ।
হুদায়বিয়ার সন্ধি কত হিজরীতে হয়
ঐতিহাসিক হুদাইবিয়ার সন্ধি ৬ষ্ঠ হিজরীর যিলকদ মাসে স্বাক্ষরিত হয়।
অর্থাৎ প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মদিনায় হিজরতের ছয় বছর
পর ৬২৮ খ্রিস্টাব্দে মক্কার কুরাইশ এবং মুসলমানদের
মধ্যে ঐতিহাসিক এই চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়।
হুদায়বিয়ার সন্ধির পটভূমি
হিজরতের পর সুদীর্ঘ ছয়টি বছর অতীত হয়ে গেল মক্কা ত্যাগী মুসলমানদের। পবিত্র কাবা
শরীফ যিয়ারতের সৌভাগ্যও তাদের হয়নি। ইতিমধ্যেই রাসূল (সাঃ) স্বপ্ন দেখলেন, তিনি
সাহাবায়ে কেরামকে নিয়ে হজ্জব্রত পালন করছেন। পবিত্র কাবা গৃহের চাবি তিনি
স্বহস্তে গ্রহণ করছেন। নবীগণের স্বপ্নও অহীর একটি অংশ। সে সুবাদে মহানবী (সাঃ)এর
এ স্বপ্নটি নিঃসন্দেহে একটি সত্য স্বপ্ন ছিল। কিন্তু এতে কাল মাস কিংবা বছরের
কোনো নির্ধারণ ছিল না।
মহানবী (সাঃ) সাহাবায়ে কেরামকে উক্ত স্বপ্নের কথা বর্ণনা করলেন। এ সংবাদে সকলেই
আনন্দ উৎফুল্ল হলেন। পবিত্র কাবাগৃহ যিয়ারত সর্বোপরি জন্মভূমি মক্কাকে একনজর
দেখার জন্য সকলেই মহানবী (সাঃ)-এর নিকট আবেগ প্রকাশ করলেন। মহানবী (সাঃ) ও রাজী
হলেন এবং চৌদ্দশত সাহাবার এক কাফেলা প্রস্তুত হলেন।
সময়টি ছিল ষষ্ঠ হিজরীর যিলকদ মাসে। মহানবী (সাঃ) উমরার ইহরাম বেধে মক্কাভিমুখে
যাত্রা করলেন। আর সাথে সাথে চললেন চৌদ্দশত সাহাবীর এক কাফেলা। আল-কাসওয়া নামক
উটের উপর আরোহন করে চলেছেন রাসূলে করীম (সাঃ)। কুরবানীর জন্য সংগে নিয়েছেন
সত্তরটি উট। যুলহুলায়কা নামক স্থানে পৌছে তিনি কুরবানীর নিদর্শন স্বরূপ উটগুলির
গলায় ফিতা বাধলেন।
এ কাফেলা যখন উসফান নামক স্থানে পৌছলো তখন তারা সংবাদ পেলেন যে, কুরাইশরা যুদ্ধের
প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাদের একটি বাহিনী ইয়ালদাহ নামক স্থানে মুসলমানদের অপেক্ষায়
প্রহর গুনছে। এ সংবাদে মহানবী (সাঃ) সাবাহায়ে কেরামকে সঙ্গে নিয়ে এক জরুরী
পরামর্শ বৈঠকে বসলেন, কি করা যায়? বিভিন্ন জন বিভিন্ন পরামর্শ দিলেন।
কেউ বললেন, যুদ্ধ করতে আসিনি আমরা। সুতরাং কাবা যিয়ারতে কেউ বাধা প্রদান করলে
অস্ত্রের মাধ্যমে আমরা তার ফায়সালা করব। আবার কেউ ভিন্ন পথে মক্কায় প্রবেশের কথা
প্রস্তাব করলেন। ইতিমধ্যে কাফেলা হুদায়বিয়ার প্রান্তে পৌঁছেছে। মহানবী (সাঃ)
অবতরণ করে সেখানেই তাবু গাড়লেন।
এ দিকে কুরাইশরা যখন জানতে পারলো যে মুসলমানরা মক্কার উপকণ্ঠে হুদায়বিয়ায় পৌঁছেছে
তখন তারা কয়েকজন প্রতিনিধি-সহ মহানবী (সাঃ)-এর খেদমতে হাযির হয়ে মহানবী (সাঃ)-এর
অভিপ্রায় জানলেন। অতঃপর এ সংবাদ কুরাইশদের শুনালেন। এ সংবাদের সত্যতা যাচাইয়ের
জন্য তারা মক্কার প্রতাপশালী সর্দার "উরওয়া" কে পাঠায়। সেও অনুরূপ রিপোর্ট পেশ
করে।
এর পর বনূ কিনানা গোত্রের সর্দার হুলায়মকে তারা প্রেরণ করলো। সে-ও মহানবী(সাঃ)-এর
অভিপ্রায়ের কথা তাদের নিকট ব্যক্ত করলেন। কিন্তু এতেও কোন কাজ হলো না। তাই মহানবী
(সাঃ) খিরাশ ইবনে উমাইয়া নামক সাহাবীকে দূতরূপে কুরাইশদের নিকট প্রেরণ করলেন।
খিরাশ মক্কায় পৌছামাত্রই কুরাইশরা তাকে হত্যার পরিকল্পনা করে। তিনি কোন মতে প্রাণ
নিয়ে রাসূলের (সাঃ) দরবারে পালিয়ে এলেন।
একটা চুড়ান্ত ফায়সালার জন্য মহানবী (সাঃ) একজন বিশিষ্ট সাহাবীকে কুরাইশদের নিকট
প্রেরণের ইচ্ছা পোষণ করলেন। সে সুবাদে তিনি হযরত উসমান গনী (রাঃ)-কে এর
নিষ্পত্তির জন্য প্রেরণ করলেন। উসমান (রাঃ) কুরাইশদের নিকট মহানবী (সাঃ)-এর উমরা
পালনের কথা ব্যক্ত করলে তারা উসমান (রাঃ)-কে আটক রাখে। এদিকে তাঁর প্রত্যাগমন
বিলম্ব হতে থাকলে মুসলমানদের মনে নানা উদ্বেগ ও আশা দোলা দিতে থাকে।
এমন সময় সংবাদ আসল যে হযরত উসমান গনী (রাঃ) কাফেরদের হাতে শাহাদাত বরণ করেছেন। এ
দুঃসংবাদে মুসলমানগণ অত্যন্ত মর্মাহত হয়ে পড়লেন। তখন মহানবী (সাঃ) একটি বাবলা
গাছের নীচে উপবিষ্ট ছিলেন। তিনি সাহাবাদেরকে সম্বোধন করে বললেন, উসমান হত্যার
প্রতিশোধ নিতেই হবে তোমরা যুদ্ধে অটল থাকার জন্য, আল্লাহর নামে নিজেদের প্রাণ
উৎসর্গ করার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হও। সাথে সাথে চৌদ্দশ সাহাবী মহানবী (সাঃ)-এর
হাতে হাত রেখে শপথ গ্রহণ করলেন এ শপথই ইসলামের ইতিহাসে রিদওয়ান নামে প্রসিদ্ধ।
এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের বলা হয়েছে: মুসলমানগণ যখন বৃক্ষের নীচে আপনার হাতে
হাতে রেখে মরণ শপথ নিয়েছিলো তখন
আল্লাহ তাআলা
তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন। তিনি তাদের হৃদয়ের আন্তরিকতা বুঝতে পেরেছেন। সুতরাং
তিনি তাদের উপর শান্তি অবর্তীন করেছেন এবং শীঘ্রই তাদেরকে বিজয় দান করেছেন। (সূরা
ফাতাহ্-১৮)
হুদায়বিয়ায় উপস্থিত সকলেই এতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছেন। বায়আত শেষ হলো। টান টান
উত্তেজনা বিরাজ করছে মুসিলিম শিবিরে। এ সংবাদ পেয়ে কুরাইশ বাহিনী ভয়ে উসমান
(রাঃ)-কে ছেড়ে দেয়। আর উসমান (রাঃ) মুসলিম শিবিরে ফিরে আসলেন।তাকে দেখে
মুসলমানদের অন্তরের প্রজ্জ্বলিত আগুন নির্বাপিত হলো।
কুরাইশরা আর কাল বিলম্ব না করে সন্ধি চুক্তির জন্য সুহায়ল ইবনে আমরকে প্রেরণ করল।
সুহায়ল রাসূল (সাঃ) এর সাথে দীর্ঘ আলোচনার পর চুক্তিতে স্বাক্ষর করল।
হুদায়বিয়ার সন্ধির শর্ত কতটি
হুদায়বিয়ার সন্ধির শর্ত ছিল মোট সাতটি। চলুন এবার আমরা দেখে নেই সেই সাতটি শর্ত
কি কিঃ
- মুসলমানরা এবার উমরা না করে মদীনায় ফিরে যাবেন।
- আগামী বছর তারা উমরা করতে পারবেন কিন্তু তারা তিন দিনের বেশী মক্কায় অবস্থান করতে পাররবেন না।
- উমরা করার সময় তারা যুদ্ধাস্ত্র নিয়ে আসতে পারবেন না। শুধু আত্মরক্ষার জন্য কোষবদ্ধ তরবারী আনতে পারবেন।
- কুরাইশ ও মুসলমানদের মধ্যে আগামী দশ বছরের জন্য যুদ্ধ-বিগ্রহ বন্ধ থাকবে।
- আরবের যে কোন গোত্র ইচ্ছা করলে মহানবী (সঃ) অথবা কুরাইশদের সাথে সন্ধি সূত্রে আবদ্ধ হতে পারবে। এতে কোন পক্ষই কোন ওযর আপত্তি করতে পারবে না।
- কোন মক্কাবাসী মদীনায় আশ্রয় নিলে মদীনার মুসলমানগণ তাকে আশ্রয় দিতে পারবে না। পক্ষান্তরে মদীনার কোন লোক মক্কায় চলে আসলে মক্কাবাসীদের উপর তাকে প্রত্যার্পণের কোন দায়িত্ব বর্তাবে না।
- এ সন্ধি চুক্তি দশ বছর বলবৎ থাকবে।
হুদায়বিয়ার সন্ধির শর্তাবলী স্থির পরবর্তী ঘটনা
সন্ধির শর্তাবলী স্থির হওয়ার পর লিপিবদ্ধ করার জন্য রাসূল (সাঃ) আলী (রাঃ)-কে
নির্দেশ দিলেন। নিদের্শানুসারে আলী (রাঃ) লিখলেন, পরম দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু
করছি। এতে সুহইল প্রতিবাদের স্বরে বলে উঠল, এ কথা লিখা যাবে না, রহমানুর রহীম কি
আমরা তা জানি না। আমরা তোমার নামে আরম্ভ করছি হে আল্লাহ লিখে থাকি। সুতরাং আপনি
এটিই লিখুন।
মহানবী (সাঃ) আলী (রাঃ)-কে পূর্ণবার তাই লিখতে বললেন। এরপর সন্ধি চুক্তিতে লেখা
হলো:এ সেই চুক্তিপত্র যার প্রতি আল্লাহর মহানবী (সাঃ) স্বীকৃতি প্রদান করেছেন।এতে
সুহায়ল আবার বলে উঠলো, মুহাম্মদ (সাঃ) যে আল্লাহর রাসূল যদি এ কথা আমরা মেনেই
নিতাম তবে আপনার সাথে আমাদের যুদ্ধ বিগ্রহ হতো কি জন্য? মুহাম্মদ (সাঃ) আল্লাহর
রাসূল এর পরিবর্তে আবদুল্লাহর পুত্র মুহাম্মদ লিখুন।
আরো পড়ুন: উকিল/অ্যাডভোকেট/ব্যারিস্টার হতে কি করবেন ? । হ দিয়ে মেয়েদের ইসলামিক নাম । মৃত ব্যক্তির পক্ষে কোরবানির নিয়ম
মহানবী (সাঃ) আলী (রাঃ)-কে আল্লাহর রাসূল মুহাম্মদ কেটে দিয়ে তার পরিবর্তে
আবদুল্লাহর পুত্র মুহাম্মদ লেখার নির্দেশ দিলেন। কিন্তু আলী (রাঃ) এ কাজে অসম্মতি
জ্ঞাপন করলে মহানবী (সাঃ) নিজেই তা কেটে দিলেন। সন্ধিপত্র লেখা সমাপ্ত হলে উভয়
পক্ষের স্বাক্ষর হয়ে গেল।
মুসলমানদের পক্ষে
আবু বকর (রাঃ), উমর (রাঃ), সাদ (রাঃ),
হযরত আলী (রাঃ)
প্রমুখ সাহাবীগণ স্বাক্ষর করলেন। এরপর রাসূল (সাঃ) সাহাবায়ে কেরামকে এ স্থানেই
উটগুলি কুরবানী করার নিদের্শ দিলেন। এরপর মাথা মুণ্ডন করত উমরার ইহরাম ভেঙ্গে
ফেললেন।
হুদায়বিয়ার সন্ধির গুরুত্ব ও তাৎপর্য
আপাতত দৃষ্টিতে সন্ধিপত্র কুরাইশদের অনুকূলেই সম্পাদিত হয়েছিল বলে মনে হয়। কিছু
দূর দুষ্টিতে বিচার করলে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, এর ফল ছিল সর্বোতভাবে
মুসলিম স্বার্থের অনুকুলে ও অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী। এ সন্ধিপত্রে স্বাক্ষর করে
মহানবী (সাঃ) এক অসাধারণ রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দুরদার্শিতার পরিচয় দিয়েছিলেন।
আরো পড়ুন: রাজশাহী টু খুলনা ট্রেনের সময়সূচী । এসি প্রাইস ইন বাংলাদেশ । আইপিএস এর দাম ও আইপিএস ব্যটারির দাম
পবিত্র কুরআন মজীদে এ সন্ধিকে সুস্পষ্ট বিজয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে।এ সন্ধির ফলে
মুসলমানগণ একটি স্বাধীন সার্বভৌম শাসন শক্তিরূপে লিখিতভাবে স্বীকৃতি লাভ করে।
ইসলামের প্রচার ও প্রসারের পথ দিন দিন প্রশস্ততর হতে থাকে।
ইসলামের সৌন্দর্য্য, শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্ত্ব বুঝতে পেরে কুরাইশরা দলে দলে ইসলাম
ধর্ম গ্রহণ করতে থাকে। বিগত ১৯ বছর কঠোর সাধনা ও পরিশ্রমের ফলে মুসলমানদের সংখ্যা
দাড়িয়েছিল চৌদ্দশত। কিন্তু হুদায়বিয়া সন্ধির দুই বছর পরেই মুসলমানাদের সংখ্যা
পৌঁছলো প্রায় দশ হাজারে।
হুদায়বিয়ার সন্ধি কি - হুদায়বিয়ার সন্ধির গুরুত্ব ও তাৎপর্য : লেখক এর মতামত
প্রিয় পাঠক আজকে আমরা আপনাদের সামনে হুদায়বিয়ার সন্ধি কি , হুদায়বিয়ার সন্ধি
কত হিজরীতে হয়, হুদায়বিয়ার সন্ধির পটভূমি, হুদায়বিয়ার সন্ধির গুরুত্ব ও
তাৎপর্য এবং হুদায়বিয়ার সন্ধির শর্ত কতটি সে সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করলাম।
এ সংক্রান্ত আপনাদের যেকোনো মতামত বা প্রশ্ন থাকলে আমাদের কমেন্ট বক্সে কমেন্ট
করে জানাতে পারেন। এরকম প্রয়োজনীয় আরও তথ্য পেতে নিয়মিত আমাদের ওয়েবসাইটটি
ভিজিট করুন এবং আমাদের ফেসবুক পেজটিতে ফলো দিয়ে রাখুন। ধন্যবাদ।।