মহানবী (সাঃ) এর বিদায় হজ্জের ভাষণ - বিদায় হজ রচনা
বিদায় হজ্জ ছিল প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর জীবনের সর্বশেষ হজ্জ। প্রিয়
নবী (সাঃ) প্রায় লক্ষাধিক সাহাবীকে সাথে নিয়ে এই হজ্জ সম্পন্ন করেন। আমরা
অনেকেই বিদায় হজ্জের ভাষণ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাই। আজকে আমরা বিদায়
হজ্জের ভাষণ এবং বিদায় হজ রচনা সম্পর্কে জানবো।
১০ম হিজরীর যিলহজ্জ মাসের ৮ তারিখ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লাম হজ্জ পালনের
নিয়তে কাবার উদ্দেশ্যে রওনা করেন। বিদায় হজ্জে তিনি যে ভাষণ প্রদান করেন তা তার
উম্মতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং দিকনির্দেশনামূলক। তাই আমাদের সকলের উচিত
বিদায় হজ্জের ভাষণ সম্পর্কে বিস্তারিত জানা।
বিদায় হজ্জের ভাষণ - বিদায় হজ রচনা
৮ই যিলহজ্জ তালবিয়ার দিন মহানবী (সাঃ) মক্কা থেকে মিনায়
যান সেখানে তাঁর জন্য টাঙানো তাঁবুতে তিনি অবস্থান করেন। এদিকে ইবাদত বন্দেগী
তিনি তাঁবুতেই আদায় করেন। এই তাঁবুতে তিনি রাত যাপন করেন ভোরে তাঁবুতেই ফজর নামায
আদায় করেন। সূর্য উদয়ের পর তিনি তাঁর উট কাসওয়ায় আরোহণ করেন এবং আরাফাত
প্রান্তরের দিকে রওয়ানা দেন এদিন ছিল ৯ই যিলহজ্জ।
এক লাখ সাহাবিসহ তিনি আরাফাতের ময়দানে পৌঁছান। সেখানে মুসলমানরা
মহানবী (সাঃ) -এর আশপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিলেন। এ সময় মুসলমানরা কেউ তালবিয়া পড়ছিলেন আবার কেউ
কেউ পড়ছিলেন তারবিয়া। তাঁরা সজোরে পড়ছিলেন।
মহানবী (সাঃ) কাউকে বারণ করেননি।আরাফাতের পূর্ব প্রান্তে
নামেরা বস্তির অদূরে মহানবী (সাঃ) -এর জন্য তাবু স্থাপন করা
হয়েছিল। তিনি সেখানে আরাম করেন।
মহানবী (সাঃ) -এর বিদায় হজ্জের ভাষণ
সূর্য পশ্চিমাকাশে যাওয়ার পর মহানবী (সাঃ) তাঁর বাহন উটটি
নিয়ে আসার নির্দেশ প্রদান করেন। তাতে আরোহণ করে তিনি আরাফাত প্রান্তরের মাঝখানে
আসেন। এখানে উটের উপর বসেই তিনি ঐতিহাসিক বিদায় হজ্জের ভাষণ দান করেন। তিনি উচ্চ
কণ্ঠে ভাষণ দেন।
প্রতিটি বাক্য তিনি বিরতি দিয়ে বলতেন। এ সময়ে রবীআ ইবনে উমাইয়া ইবনে খালফ
মহানবী (সাঃ) -এর উচ্চারিত বাক্যগুলো সজোরে পুনরাবৃত্তি করতেন।
আল্লাহ তায়ালার প্রশংসা করার পর মহানবী (সাঃ) সমবেত মুসলমানদের
উদ্দেশে বলেন:
১. হে সমবেত মানুষ! তোমরা আমার কথা মনোযোগ সহকারে শুনে রাখ। কারণ এ বছরের পর হয়তো
আমি এখানে তোমাদের সাথে আর কখনো মিলিত হতে পারবো না।
আরো পড়ুন: উকিল/অ্যাডভোকেট/ব্যারিস্টার হতে কি করবেন ? । হ দিয়ে মেয়েদের ইসলামিক নাম । রাজশাহী টু খুলনা ট্রেনের সময়সূচী
২. হে মানুষ! তোমাদের জীবন, তোমাদের সম্পদ কেয়ামত পর্যন্ত পরস্পরের জন্য সম্মানিত
যেমনি করে এই দিন ও এই মাস তোমাদের নিকট সম্মানিত। অচিরেই তোমরা তোমাদের
প্রতিপালকের সাথে মিলিত হবে। তিনি তোমাদের কাজকর্ম সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবেন। ভাল
করে জেনে রাখ আমি তোমাদের নিকট তোমাদের প্রতিপালকের বাণী পৌঁছে দিয়েছি। যার নিকট
কারো আমানত রয়েছে, সে অবশ্যই তা মালিককে ফিরিয়ে দেবে। আজ থেকে সকল প্রকার সুদ
মওকুফ করা হলো। তোমরা শুধু আসল পাওনা পাবে। তোমরা কারও প্রতি জুলুম করবে না।
তোমাদের সাথেও জুলুম করা হবে না। আল্লাহ্ তায়ালাই সুদ নিষিদ্ধ করেছেন। আব্বাস
ইবনে আবদুল মোত্তালিবের যে সুদ অন্যদের যিম্মায় রয়েছে, তা মওকুফ করা হলো।
৩.স্মরণ রেখ, অজ্ঞতা আমলের সকল হত্যার কিসাস বা রক্তের বদলা রক্ত কিংবা ক্ষতিপূরণ
রহিত করা হলো। সবার আগে আমি বনু হাশিম গোত্রের ইবনে রবীআ ইবনে হারেছ ইবনে আবদুল
মোত্তালিবের জীবনের বদলা ও ক্ষতিপূরণ মাফ করে দিচ্ছি।
8.মনোযোগ সহকারে শোন, এখন থেকে আরবে আর শয়তানের পূজা করা হবে না। অবশ্য ছোটোখাটো
ব্যাপার যেগুলো তোমরা বড় পাপ মনে করবে না সেগুলোতে শয়তানের অনুসরণ হবে এবং তাতেই
সে সন্তুষ্ট থাকবে। সুতরাং ধর্মীয় ব্যাপারে তোমরা শয়তানের প্রভাব থেকে দূরে
থাকবে।
৫. হে মানুষ! সম্মানিত বা নিষিদ্ধ মাসগুলো বৈধ দিনের সাথে অদল-বদল করা কুফরী
ব্যাপার। কোন মুমিন তাতে জড়িত হতে পারে না। কিন্তু কাফেরদের তা থেকে বেঁচে থাকা
সম্ভব নয়। তারা এ বছরের (সম্মানিত চার) মাসের এক মাস আগামী বছরের হিসাবে রেখে
দেয়। আগামী বছর তা বাকীর হিসাবেও থেকে যায়। এটাই আল্লাহ তায়ালার তরফ থেকে
হারামকৃত বিষয়কে হালাল গণ্য করা এবং হালালকৃত বিষয়কে হারাম পণ্য বই কিছু নয়। দেখ,
আল্লাহ্ তায়ালা প্রথমে আকাশ ও পৃথিবী তৈরি করেন। সময় আবর্তিত হয়ে পুনরায় আজকের
বিন্দুতে এসে পড়েছে। আল্লাহ্ তায়ালার নিকট মাস হচ্ছে বারটি। তার মধ্যে চারটি
হচ্ছে সম্মানিত বা নিষিদ্ধ। তিনটি পরপর (যিলকদ থেকে মুহাররম) রজব হচ্ছে একলা। এটি
জুমাদাল উলা ও শাবান মাসের মধ্যবর্তী।
৬. হে মানুষ! মহিলাদের উপর তোমাদের অধিকার রয়েছে। তোমাদের উপরও মহিলাদের অধিকার
রয়েছে। মহিলাদের উপর তোমাদের অধিকার হলো, তারা অন্য পুরুষকে তাদের নিকটে আসতে
দিবে না। এটা তোমাদের জন্য ক্রোধ ও ক্ষোভের কারণ হবে। মহিলাদের নির্লজ্জতা থেকে
সম্পূর্ণ দূরে থাকতে হবে। যদি তারা এরূপ করে, তাহলে আল্লাহ্ তায়ালা তোমাদের
অনুমতি দিয়েছেন, তোমরা তাদেরকে আলাদা শয্যায় শুতে দিবে এবং হালকা দৈহিক শাস্তি
দিবে। অতঃপর তারা সংশোধিত হলে যথারীতি তাদের পানাহারের দিকে লক্ষ্য রাখবে।
মহিলাদের সাথে সদয় ব্যবহার করবে। তারা তোমাদের সাহায্যকারিণী। তারা নিজেদের জন্য
কিছুই রাখে না। তোমরা আল্লাহ তায়ালার এই আমানতের দায়িত্ব গ্রহণ করেছো। আল্লাহ
তায়ালার নির্ধারিত বাক্যের (ইজাব-কবুলের) মাধ্যমে তাদেরকে নিজেদের জন্য বৈধ করে
নিয়েছো।
৭. হে মানুষ! আমার কথাগুলো অনুধাবন কর। কারণ আমি আল্লাহ তায়ালার বার্তা তোমাদের
নিকট পৌঁছে দিয়েছি। আমি তোমাদের মধ্যে যেসব জিনিস রেখে যাচ্ছি, সেগুলো যদি
সুদৃঢ়ভাবে ধারণ করো, কখনো পথভ্রষ্ট হবে না। আর তা হচ্ছে আল্লাহর কিতাব এবং তাঁর
রাসূলের সুন্নাত।
৮. হে মানুষ! তোমরা আমার কথাগুলো গভীর মনোযোগ দিয়ে শোনো। মনে রেখো এক মুসলমান অপর
মুসলমানের ভাই। এবং সকল মুসলমান পরস্পরের ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ। সুতরাং নিজের
ভাইয়ের সম্মতি ছাড়া তার কোন জিনিস নেয়া কারো জন্য বৈধ নয়। তোমরা একে অপরের উপর
জুলুম করা থেকে বিরত থাকবে।
৯. হে আল্লাহ! তুমি শুনছো, আমি তোমার বার্তা মানুষের নিকট পৌঁছে দিয়েছি।
মহানবী (সাঃ) চাচ্ছিলেন মানুষ যেন তাঁর এই ভাষণ ভাল করে
আত্মস্থ করে। এই উদ্দেশ্যে তিনি প্রতিটি বাক্য থেমে থেমে বলছিলেন। রবীআ প্রতিটি
বাক্য উচ্চকণ্ঠে পুনরাবৃত্তি করছিলেন। পুরোপুরি আত্মস্থ করার জন্য
মহানবী (সাঃ) ভাষণের মাঝে সমবেতদের নিকট কিছু প্রশ্নও
রাখতেন। তিনি বলেছেন, 'তোমরা কি জান আজ কি বার?'
সমবেতরা জবাব দিতেন, আজ হজ্জে আকবরের দিন।
মহানবী (সাঃ) বলতেন, স্মরণ রেখ, আল্লাহ্ তায়ালা কিয়ামত
পর্যন্ত তোমাদের রক্ত, তোমাদের সম্পদ পরস্পরের জন্য হারাম করেছেন- যেমনটি করেছেন
আজকের দিন ও এই মাস।
ভাষণ শেষ করে তিনি বললেন, আমি কি আল্লাহ্ তায়ালার বার্তা তোমাদের নিকট পৌঁছে
দিয়েছি?সকল দিক থেকে আওয়ায ধ্বনিত হয়, "অবশ্যই।"
মহানবী (সাঃ) বলেন, হে আল্লাহ্! তুমি সাক্ষী থেকো, আমি
আমার কর্তব্য পালন করেছি।
দ্বীন পূর্ণ হওয়ার সুসংবাদ
ভাষণ শেষ হওয়ার পর মহানবী (সাঃ) উট থেকে অবতরণ করেন। যোহর
ও আসর নামায এক সাথে আদায় করেন। এরপর আবার উটে আরোহন করেন। সাখরাত নামক স্থানে
অবতরণ করেন। সেখানে পবিত্র কোরআনের শেষ আয়াত নাযিল হয়। তখনই তিনি মানুষকে আয়াতটি
শুনিয়ে দেন:
"আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্মকে পরিপূর্ণ করে দিলাম, তোমাদের প্রতি আমার
অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম এবং ধর্ম হিসেবে ইসলামকে তোমাদের জন্য মনোনীত করলাম।"
হযরত আবু বকর (রা.) এই আয়াত শুনে কেঁদে ফেলেন। কারণ তিনি তাঁর ঈমানী প্রজ্ঞা
দ্বারা বুঝে ফেলেছিলেন, রিসালাতের মিশন যখন সম্পন্ন হয়ে গেছে, আল্লাহ তায়ালা অদূর
ভবিষ্যতে মহানবী (সাঃ) -কে পৃথিবী থেকে উঠিয়ে নেবেন।
মহানবী (সাঃ) আরাফাত থেমে মুযদালেফায় রওয়ানা দেন। সে রাত
তিনি মুযদালেফায় অতিবাহিত করেন। ফজরের নামাযের পর তিনি মুযদালেফা থেকে রওয়ানা হন।
এতে জামারায় কংকর নিক্ষেপ করেন। এরপর মীনায় পৌঁছে নিজের তাঁবুতে অবস্থান করেন।
মহানবী (সাঃ) মদীনা থেকে কোরবানীর জন্য একশ উট নিয়ে
এসেছিলেন। ৬৩টি উট তিনি নিজের তরফ থেকে কোরবানী করেন। এই হিসাব ছিল তাঁর বয়সের
প্রতি বছরের জন্য একটি করে। অবশিষ্ট ৩৭টি হযরত আলী (রা.) কোরবানী করেন। এরপর
মহানবী (সাঃ) পবিত্র শির মুণ্ডন করেন। তাতে করে ইহরাম খুলে
তিনি হজ্জের সকল আনুষ্ঠানিকতা থেকে মুক্ত হন।
এই হজ্জকে কেউ কেউ বলেন, 'হিজ্জাতুল বিদা' বা বিদায় হজ্জ। কেউ কেউ 'হিজ্জাতুল
ইসলাম', আবার কেউ কেউ 'হিজ্জাতুল বালাগ' নামে অভিহিত করেন। মূলত এই হজ্জের
ক্ষেত্রে তিনটি নামই প্রযোজ্য হতে পারে। এটা ছিল
মহানবী (সাঃ) -এর শেষ হজ্জ।
আরো পড়ুনঃ কতটুকু বীর্য বের হলে গোসল ফরজ হয় । জ দিয়ে মেয়েদের ইসলামিক নাম । হুদায়বিয়ার সন্ধির গুরুত্ব ও তাৎপর্য
সেই হিসাবে একে বিদায় হজ্জ বলা যায়। কারণ এরপর আর কখনো
মহানবী (সাঃ) -এর মক্কা মুকাররামা ও বায়তুল্লাহ্ যিয়ারতের সুযোগ
হয়নি। 'হিজ্জাতুল ইসলাম' এজন্য যে, আল্লাহ তায়ালা ইসলামের সম্পূর্ণতার ঘোষণা এই
হজ্জের সময়ই করেন। আর 'হুজ্জাতুল বালাগ' বলা হয় এ জন্য যে, আল্লাহ্ তায়ালা যেসব
বিষয় মানুষকে অবহিত করার জন্য মহানবী (সাঃ) -কে নির্দেশ
দিয়েছিলেন, তিনি এই হজ্জের সময় তা সম্পন্ন করেন।
বস্তুতঃ মহানবী (সাঃ) ছিলেন সুসংবাদদানকারী ও সর্তককারী।
এই দিক থেকে মহানবী (সাঃ) -এর. উপর যেসব দায়িত্ব ন্যস্ত হয়েছিল,
এই হজ্জ পালনের মাধ্যমে তিনি তা যথাযথভাবে সম্পন্ন করেন।
বিদায় হজ্জের ভাষণ - বিদায় হজ রচনা : লেখক এর মতামত
প্রিয় পাঠক আমরা আপনাদের সামনে মহানবী (সাঃ) এর বিদায় হজ
এবং বিদায় হজ্জের ভাষণ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করলাম। আমাদের প্রত্যেক মুসলিমের
জীবনের এই ভাষণের গুরুত্ব অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ।
এ সংক্রান্ত আপনাদের যেকোনো মতামত বা প্রশ্ন থাকলে আমাদের কমেন্ট বক্সে কমেন্ট
করে জানাতে পারেন। এরকম প্রয়োজনীয় আরও তথ্য পেতে নিয়মিত আমাদের ওয়েবসাইটটি
ভিজিট করুন এবং আমাদের ফেসবুক পেজটিতে ফলো দিয়ে রাখুন। ধন্যবাদ।।