মদিনা সনদের ধারা কয়টি - মদিনা সনদ কি
প্রিয় পাঠক মদিনা সনদ শুধু মুসলিমদের জন্য নয় পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম
গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা কেননা মদিনা সনদ সমগ্র পৃথিবীর প্রথম লিখিত সংবিধান। আজকে
আমরা আপনাদের সামনে মদিনা সনদ কি ? , মদিনা সনদের ধারা কয়টি , মদিনা সনদ কত সালে
লিখিত হয় এবং মদিনা সনদ এর গুরুত্ব সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব।
পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই মদিনা সনদ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে
মনোযোগ সহকারে আমাদের পোস্টটি শেষ পর্যন্ত পড়ার অনুরোধ রইল। আমরা আশা করি,
আমাদের এই পোস্ট থেকে আপনি মদিনা সনদ সংক্রান্ত আপনার সকল প্রশ্নের উত্তর পেয়ে
যাবেন।
মদিনা সনদের ধারা কয়টি - মদিনা সনদ কি
মদিনা সনদ কি ?
৬২২ খ্রিস্টাব্দে প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ পবিত্র মক্কা নগরী থেকে মদিনায় হিজরত
করেন। সেই সময় মদিনার নাম ছিল ইয়াসরিব। মদিনায় সেই সময় মুসলমান ও পৌত্তলিক
এবং ইহুদিরা বসবাস করত। বিভিন্ন গোত্রে বিভক্ত ইয়াসরিব নগরী সেই সময় গোত্রীয়
কোন্দল এবং হিংসা-বিদ্বেষে পরিপূর্ণ ছিল।
বিশেষ করে ইয়াসরিবের প্রধান দুই গোত্র বানু আউস এবং বানু খাযরাজ
সম্প্রদায় এর মধ্যে রীতিমতো যুদ্ধবিগ্রহ খুবই সাধারণ বিষয় ছিল। এই রুগ্ন
ইয়াসরিবকে শান্তি শৃঙ্খলা এবং নিরাপত্তার শহরে পরিণত করার জন্য ইয়াসরিব বাসীর
সাথে মিলে যে সনদ তৈরি করেন তাই ছিল মদিনা সনদ। যা পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম লিখিত
সংবিধান। তাই একে অনেকেই মদিনার সংবিধান বলে উল্লেখ করে থাকেন।
মদিনা সনদ কত সালে লিখিত হয়
মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মদিনায় হিজরতের অল্প
কিছুদিন পরেই মদিনা সনদ লিখিত হয়, সেই বর্ণনা হিসেবে হিজরতের বছর অর্থাৎ ৬২২
খ্রিস্টাব্দে মদিনা সনদ লিখিত হয়।
মদিনা সনদের ধারা কয়টি
অধিকাংশ সিরাত গ্রন্থের বর্ণনা অনুযায়ী মদিনা সনদের ধারা ৪৭ টি। আবার
সিরাতে ইবনে হিশামসহ আরো কিছু সিরাত গ্রন্থের বর্ণনা অনুযায়ী মদিনা সনদের ধারা ৫৮ টি। আমাদের
আলোচনায় আমরা ৪৭ টি এবং ৫৮ টি উভয় গুলোই আলোচনা করব।
মদিনা সনদের ধারা সমূহ
প্রথমেই আমরা জেনে নেই অধিকাংশ সিরাজ গ্রন্থে মদিনা সনদের যে ৪৭ টি ধারা বলা
হয়েছে সেগুলো সম্পর্কেঃ
মদিনা সনদ এর ধারা ৪৭ টি
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
(১) এটি মুহাম্মদ (সাঃ) এর পক্ষ থেকে একটি দলিল , যার মাধ্যমে কুরাইশ ও
ইয়াসরিবের মুমিন ও মুসলিমদের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করা হয়েছে, এবং যারা তাদের
অনুসরণ করেছে, তাদের সাথে যোগ দিয়েছে এবং তাদের সাথে কাজ করেছে।
(২) সকল মানুষ একই সম্প্রদায় (উম্মাহ)।
(৩) কুরাইশ মুহাজিররা তাদের বর্তমান রীতি অনুসারে তাদের রক্তপন প্রদান করবে এবং
তাদের বন্দীদের মুক্ত করবে, যেমন মুমিনদের মধ্যে সাধারণ দয়া ও ন্যায়বিচার।
(৪-৮) বনী আউফ তাদের বর্তমান রীতি অনুসারে রক্তপন প্রদান করবে; প্রতিটি অংশ তাদের
বন্দীদের মুক্ত করবে, যেমন মুমিনদের মধ্যে সাধারণ দয়া ও ন্যায়বিচার। একইভাবে
বনী সাইদা, বনী হারিস, বনী জুশাম এবং বনী নাজ্জারও ।
(৯-১১) বনী আমর বিন আউফ, বিন-নাবিত এবং বিন-আউসও একইভাবে।
(১২)(ক) মুমিনরা তাদের মধ্যে কাউকে নিঃস্ব রাখবে না, তার মুক্তির টাকা বা
রক্তপণের বিনিময় প্রদানে সহযোগীতা করবে।
(খ) একজন মুমিন অন্য মুসলিমের মুক্ত ব্যক্তিকে তার বিরুদ্ধে মিত্র হিসেবে গ্রহণ
করবে না।
(১৩) খোদাভীরু মুমিনরা বিদ্রোহী অথবা মুমিনদের মধ্যে অন্যায়, পাপ, শত্রুতা বা
দুর্নীতি ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টাকারীর বিরুদ্ধে থাকবে; প্রতিটি মানুষের হাত তার
বিরুদ্ধে থাকবে, এমনকি সে তাদের একজনের পুত্র হলেও।
(১৪) একজন মুমিন একজন মুমিনকে একজন কাফেরের জন্য হত্যা করবে না, এবং সে একজন
কাফেরকে একজন মুমিনের বিরুদ্ধে সাহায্য করবে না।
(১৫) আল্লাহর সুরক্ষা হলো একটি, তাদের মধ্যে সবচেয়ে কম সংখ্যক ব্যক্তি তাদের
পক্ষ থেকে অপরিচিত ব্যক্তিকে সুরক্ষা দিতে পারে। বাইরের লোকদের বাদ দিয়ে মুমিনরা
একে অপরের বন্ধু।
(১৬) যে ইহুদি আমাদের অনুসরণ করবে তার জন্য সাহায্য এবং সমতা। তার উপর কোন জুলুম
করা হবে না এবং তার শত্রুদেরও সাহায্য করা হবে না।
(১৭) মুমিনদের শান্তি অবিভাজ্য। যখন মুমিনরা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করবে তখন কোন পৃথক
শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে না। সকলের জন্য শর্ত ন্যায্য এবং ন্যায়সঙ্গত হওয়া উচিত।
(১৮) প্রতিটি অভিযানে একজন আরোহীকে তার পিছনে অন্য একজনকে নিতে হবে।
(১৯) মুমিনদের অবশ্যই আল্লাহর পথে একে অপরের রক্তপাতের প্রতিশোধ নিতে হবে।
(২০) (ক) খোদাভীরু মুমিনরা সর্বোত্তম এবং সবচেয়ে সঠিক পথ উপভোগ করে।
(খ) কোন মুশরিক কুরাইশের ব্যক্তির সম্পত্তি তার সুরক্ষায় নেবে না এবং সে কোন
মুমিনের বিরুদ্ধে হস্তক্ষেপ করবে না।
(২১) যে ব্যক্তি যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়াই কোন মুমিনকে হত্যা করার জন্য দোষী
সাব্যস্ত হয়, তার প্রতিশোধ নেওয়া হবে যদি না তার নিকটাত্মীয় (রক্তপণ দিয়ে)
সন্তুষ্ট হয়, এবং মুমিনরা তার বিরুদ্ধে এক ব্যক্তির মতো থাকবে এবং তারা তার
বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বাধ্য থাকবে।
(২২) যে মুমিন এই দলিলের কথা মেনে চলে এবং আল্লাহ ও শেষ দিবসে বিশ্বাস করে, তার
জন্য কোন দুষ্কৃতকারীকে সাহায্য করা বা তাকে আশ্রয় দেওয়া বৈধ হবে না। যদি সে তা
করে তবে কিয়ামতের দিন আল্লাহর অভিশাপ এবং তাঁর ক্রোধ তার উপর বর্ষিত হবে, এবং
তার কাছ থেকে কোন তওবা বা মুক্তিপণ গ্রহণ করা হবে না।
(২৩) যখনই কোন বিষয়ে তোমরা মতবিরোধ করো, তখন অবশ্যই আল্লাহ ও মুহাম্মদের কাছে তা
তুলে ধরতে হবে।
(২৪) যতক্ষণ পর্যন্ত ইহুদিরা মুমিনদের সাথে লড়াই করবে ততক্ষণ পর্যন্ত ইহুদিরা
যুদ্ধের খরচ বহন করবে।
(২৫) আউফ গোত্রের ইহুদিরা মুমিনদের সাথে এক সম্প্রদায় , তাদের মুক্ত ব্যক্তি এবং
তাদের ব্যক্তিরা, যারা অন্যায় ও পাপ করে, কারণ তারা নিজেদের এবং তাদের পরিবারের
ক্ষতি করে।
(২৬-৩৫) একই কথা প্রযোজ্য বিন আল-নাজ্জার, বিন আল-হারিস, বিন সায়িদা, বিন জুশাম,
বিন আল-আউস, বিন সা'লাবা এবং জাফনা, যা সালাবা এবং বিন আল-শুতাইবার একটি গোত্র,
তাদের ক্ষেত্রেও। আনুগত্য হলো বিশ্বাসঘাতকতার বিরুদ্ধে সুরক্ষা। সা'লাবার মুক্ত
ব্যক্তিরা নিজেদের মতো। ইহুদিদের ঘনিষ্ঠ বন্ধুরাও নিজেদের মতো।
(৩৬) মুহাম্মদ সাঃ এর অনুমতি ছাড়া তাদের কেউ যুদ্ধে যাবে না, কিন্তু তাকে আঘাতের
প্রতিশোধ নিতে বাধা দেওয়া হবে না। যে ব্যক্তি সতর্ক না করে কাউকে হত্যা করে সে
নিজেকে এবং তার পরিবারকে হত্যা করে, যদি না সে তার উপর অন্যায় করে, কারণ আল্লাহ
তা গ্রহণ করবেন।
(৩৭) ইহুদিদের তাদের খরচ বহন করতে হবে এবং মুসলমানদের তাদের খরচ বহন করতে হবে। এই
দলিলের লোকদের আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে একে অপরকে সাহায্য করতে হবে। তাদের অবশ্যই
পারস্পরিক পরামর্শ এবং পরামর্শ নিতে হবে, এবং আনুগত্য হলো বিশ্বাসঘাতকতার
বিরুদ্ধে সুরক্ষা। একজন পুরুষ তার মিত্রের অপকর্মের জন্য দায়ী নয়। নির্যাতিতকে
সাহায্য করতে হবে।
(৩৮) যুদ্ধ যতদিন স্থায়ী হবে ততদিন ইহুদিদের বিশ্বাসীদের সাথে অর্থ প্রদান করতে
হবে।
(৩৯) ইয়াসরিব এই চুক্তির লোকদের জন্য একটি আশ্রয়স্থল হবে।
(৪০) সুরক্ষাপ্রাপ্ত একজন অপরিচিত ব্যক্তি তার আশ্রয়স্থল হিসেবে থাকবেন, কোন
ক্ষতি করবেন না এবং কোন অপরাধ করবেন না।
(৪১) একজন মহিলাকে কেবল তার পরিবারের সম্মতিতেই সুরক্ষা দেওয়া হবে।
(৪২) যদি কোনও বিরোধ বা বিতর্ক সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে তবে তা অবশ্যই আল্লাহ এবং
আল্লাহর রাসূল মুহাম্মদ(সাঃ) এর কাছে প্রেরণ করতে হবে। এই চুক্তিতে যা ধার্মিকতা
এবং সৎকর্মের নিকটতম তা আল্লাহ গ্রহণ করেন।
(৪৩) কুরাইশ এবং তাদের সাহায্যকারীদের সুরক্ষা দেওয়া হবে না।
(৪৪) চুক্তিবদ্ধ পক্ষগুলি ইয়াসরিবের উপর যেকোনো আক্রমণের বিরুদ্ধে একে অপরকে
সাহায্য করতে বাধ্য।
(৪৫) (ক) যদি তাদের শান্তি স্থাপন এবং তা বজায় রাখার জন্য ডাকা হয় তবে তাদের তা
করতে হবে; এবং যদি তারা মুসলমানদের উপর অনুরূপ দাবি করে তবে যুদ্ধের ক্ষেত্র
ব্যতীত তা অবশ্যই বাস্তবায়ন করতে হবে।
(খ) প্রত্যেকেরই তার অংশ থাকবে যে পক্ষ থেকে সে তার অংশ পাবে।
আরো পড়ুন: উকিল/অ্যাডভোকেট/ব্যারিস্টার হতে কি করবেন ? । হ দিয়ে মেয়েদের ইসলামিক নাম । মৃত ব্যক্তির পক্ষে কোরবানির নিয়ম
(৪৬) আল-আউসের ইহুদিরা, তাদের মুক্ত ব্যক্তিরা এবং তারা এই দলিলের লোকদের সাথে
একই অবস্থানে রয়েছে, এই দলিলের লোকদের প্রতি সম্পূর্ণ আনুগত্যের মাধ্যমে।
আনুগত্য হল বিশ্বাসঘাতকতার বিরুদ্ধে সুরক্ষা। যে ব্যক্তি অর্জন করে সে অবশ্যই এটি
নিজের জন্য অর্জন করবে। আল্লাহ এই দলিলকে অনুমোদন করেন।
(৪৭) এই কাজ অন্যায়কারী এবং পাপীকে রক্ষা করবে না। যে ব্যক্তি যুদ্ধে বের হয়
এবং যে ব্যক্তি শহরে ঘরে থাকে সে নিরাপদ থাকে যদি না সে অন্যায় এবং পাপ করে
থাকে। আল্লাহ হলেন সৎ এবং আল্লাহ-ভীরু মানুষের রক্ষক এবং মুহাম্মদ হলেন ঈশ্বরের
প্রেরিত।
প্রিয় পাঠক, চলুন এবার আমরা জেনে নেই অন্যান্য যে সকল গ্রন্থে ৫৮ টি
ধারার কথা উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলো সম্পর্কেঃ
মদিনা সনদের ধারা ৫৮ টি
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
- মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, কুরাইশ ও ইয়াসরিবের মু'মিন মুসলমানগণ এবং পরবর্তীকালে যারা তাদের অনুসারী হয়ে তাদের সাথে শরীক হবে ও একসাথে জিহাদে অংশগ্রহণ করবে, তাদের পক্ষ থেকে এ একটি ঘোষণাপত্র।
- সমগ্র মানব জাতির মধ্যে তারা একটি স্বতন্ত্র উম্মাহ।
- কুরাইশদের মধ্য থেকে আগত মুহাজিররা তাদের ইসলাম গ্রহণকালীন অবস্থার ওপর বহাল থাকবে, তাদের পরস্পরের মধ্যে ক্ষতিপূরণ দানের নীতি অক্ষুণ্ণ থাকবে, তারা বন্দীদেরকে ন্যায়সঙ্গতভাবে ও পারস্পরিক গ্রহণযোগ্য পন্থায় মুক্তিপণ নিয়ে মুক্তি দিতে পারবে।
- বনু আওফও ইসলাম গ্রহণকালীন অবস্থার ওপর বহাল থাকবে, তাদের পরস্পরের মধ্যে সাবেকী ক্ষতিপূরণ দানের নীতি অটুট থাকবে, প্রত্যেক সম্প্রদায়ের মু'মিনদের মধ্যে মুক্তিপণ নিয়ে বন্দীকে মুক্তি দেয়ার বিধান চালু থাকবে।
- বনু সায়েদাও তাদের ইসলাম গ্রহণকালীন অবস্থার ওপর বহাল থাকবে। তাদের প্রত্যেক গোষ্ঠীর মুমিনদের মধ্যে বন্দীকে মুক্তিপণ নিয়ে ছেড়ে দেয়া চলবে।
- বনু হারেস তাদের ইসলাম গ্রহণকালীন অবস্থার ওপর বহাল থাকবে। তাদের পরস্পরের মধ্যে সাবেকী ক্ষতিপূরণ দানের নীতি অক্ষুণ্ণ থাকবে। তাদের প্রত্যেক গোষ্ঠীর মু'মিনদের মধ্যে বন্দীকে মুক্তিপণের ভিত্তিতে মুক্তি দেয়ার রীত অব্যাহত থাকবে।
- বনু জুশামও ইসলাম গ্রহণকালীন অবস্থার ওপর বহাল থাকবে। তাদের সাবেকী ক্ষতিপূরণ দানের নীতি অক্ষুণ্ণ থাকবে। তাদের প্রত্যেক গোষ্ঠীর মু'মিনদের মধ্যে মুক্তিপণের ভিত্তিতে বন্দীকে মুক্তি দেয়ার নীতি চালু থাকবে।
- বনু নাজ্জারও ইসলাম গ্রহণকালীন অবস্থার ওপর বহাল থাকবে। তাদের প্রত্যেক গোষ্ঠীর মুমিনদের মধ্যে ন্যায়সঙ্গতভাবে মুক্তিপণ নিয়ে বন্দীকে মুক্তি দেয়ার রীতি চালু থাকবে।
- বনু আমর ইবনে আওফ ইসলাম গ্রহণকালীন অবস্থার ওপর বহাল থাকবে। তাদের সাবেকী ক্ষতিপূরণ দানের রীতি অব্যাহত থাকবে। তাদের প্রত্যেক গোষ্ঠীর মুমিনদের মধ্যে ন্যায়সঙ্গতভাবে মুক্তিপণের ভিত্তিতে বন্দীকে মুক্তি দেয়া চলবে।
- বনু নাবীত ইসলাম গ্রহণকালীন অবস্থার ওপর বহাল থাকবে। তাদের সাবেকী ক্ষতিপূরণ দানের রীতি চালু থাকবে। তাদের প্রত্যেক গোষ্ঠীর মু'মিনদের মধ্যে ন্যায়সঙ্গতভাবে মুক্তিপণের ভিত্তিতে বন্দী মুক্তির নীতি অক্ষুণ্ণ থাকবে।
- বনু আওস ইসলাম গ্রহণকালীন অবস্থার ওপর বহাল থাকবে। তাদের প্রত্যেক গোষ্ঠীর মু'মিনদের মধ্যে ন্যায়সঙ্গতভাবে মুক্তিপণ নিয়ে বন্দী মুক্তির নীতি অব্যাহত থাকবে।
- মু'মিনগণ তাদের মধ্যকার ঋণগ্রস্ত ও অধিক সন্তানধারী প্রত্যেক ব্যক্তিকে ক্ষতিপূরণ ও মুক্তিপণদানে সঙ্গতভাবে আর্থিক সাহায্য করবে।
- কোন মুমিন অন্য মুমিনের মিত্রের বিরোধিতা করবে না।
- খোদাভীরু মুমিনগণ তাদের মধ্যকার বিদ্রোহী, ঘোরতর নির্যাতক, অপরাধী, মুসলিম সমাজের স্বার্থের ক্ষতিকারক ও বিপর্যয় সৃষ্টিকারকের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেবে এবং এ ধরনের অপরাধীর বিরুদ্ধে সকলে ঐক্যবদ্ধভাবে পদক্ষেপ নেবে, চাই সে তাদের কারো ছেলেই হোক না কেন।
- কোন কাফিরের স্বার্থে এক মুমিন অন্য মুমিনকে হত্যা করবে না এবং কোন কাফিরকে কোন মুমিনের বিরুদ্ধে সাহায্য করবে না।
- মুসলিম রাষ্ট্রে অনুগত অমুসলিমের অধিকার সমানভাবে নিরাপদ। একজন নগণ্যতম অমুসলিমকেও মুসলমানরা পূর্ণ নিরাপত্তাসহ আশ্রয় দেবে।
- মুমিনরা পরস্পরের মিত্র হয়ে থাকবে, তবে অন্যদের বেলায় এ কথা প্রযোজ্য নয়।
- আর ইহুদীদের মধ্য হতে যে ব্যক্তি আমাদের আনুগত্য ও অনুসরণ করবে, সে আমাদের সমান অধিকার ও সাহায্য লাভ করবে। এ ধরনের লোকদের ওপর কোন যুলুম চলতে দেয়া হবে না এবং তাদের ওপর কাউকে হামলা চালাতে সাহায্য করা হবে না।
- মুমিনদের রক্ষাকবচ সবার ক্ষেত্রে এক ও অভিন্ন।
- ইসলামের স্বার্থে কোন যুদ্ধ সংঘটিত হলে সেই যুদ্ধে মুসলমান কোন অমুসলমানের সাথে সমতা ও ন্যায়ের ভিত্তিতে ছাড়া আপোষরফা করবে না।
- আমাদের মধ্য হতে প্রতিটা যোদ্ধাদল অন্য যোদ্ধাদলকে অনুসরণ করবে।
- মুমিনদের একজন অন্যজনকে হত্যা করতে পারবে শুধুমাত্র হত্যার বিনিময়ে এবং আল্লাহর বিধান অনুসারে।
- খোদাভীরু মুমিনগণ সর্বশ্রেষ্ঠ ও দৃঢ়তম আদর্শের ওপর প্রতিষ্ঠিত।
- মদীনার কোন মুশরিক কুরাইশ সম্প্রদায়ের কারো জানমালের রক্ষক বা জিম্মাদার হতে পারবে না, আর কোন মুমিনের ক্ষতি সাধনে তাকে প্রশ্রয় দেবে না।
- যে ব্যক্তি কোন মুমিনকে মৃত্যুদণ্ড যোগ্য অপরাধ না করা সত্ত্বেও হত্যা করবে এবং তা যথাযথভাবে প্রমাণিত হবে, তাকে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করা হবে। অবশ্য নিহত ব্যক্তির উত্তরাধিকারীকে অন্য কোন উপায়ে খুশী করে থাকলে প্রাণদণ্ড হবে না। তবে সর্বাবস্থায় মুমিনরা সকলে ঐ মুসলিম হত্যার বিরুদ্ধে থাকবে এবং তার পক্ষপাতিত্ব করা কোন মুমিনের জন্য হালাল হবে না।
- এই ঘোষণাপত্রকে মেনে নিয়েছে এবং আল্লাহ ও আখিরাতে অটুট বিশ্বাস রাখে এমন কোন মুমিনের জন্য ইসলামী বিধানে অযৌক্তিক জিনিস সংযোজনকারীর সাহায্য করা বা আশ্রয় দেয়া বৈধ নয়।
- যে ব্যক্তি এ ধরনের লোককে সাহায্য করবে কিংবা আশ্রয় দেবে তার ওপর আল্লাহর লানত এবং কিয়ামতের দিন আল্লাহর গজব নামবে। তার পক্ষে কোন সুপারিশ বা পণ গ্রহণ করা হবে না।
- আর তোমরা যখনই কোন বিষয়ে মতবিরোধে লিপ্ত হবে, তখন সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের শরণাপন্ন হবে।
- মু'মিনরা যতদিন যুদ্ধরত থাকবে ততদিন ইহুদীরা তাদের যুদ্ধের রসদ যোগানোতে অংশ নেবে।
- বনু আওফের ইহুদীরা মুমিনদের সাথে একই উম্মাতভুক্ত বলে গণ্য হবে, তারা নিজে এবং তাদের মিত্ররাও।
- কিন্তু মুসলমানরা ও ইহুদীরা সে অবস্থায় নিজ নিজ ধর্ম পালন করবে।
- যে ব্যক্তি যুলুম অত্যাচার ও অপরাধমূলক কাজে লিপ্ত হবে সে কেবল নিজের ও নিজের পরিবার পরিজনের ধ্বংসই ডেকে আনবে।
- বনু নাজ্জারভুক্ত ইহুদীদের অধিকার বনু আওফের ইহুদীদের সমান। অনুরূপভাবে বনু হারেস, বনু সায়েদা, বুন জুশাম, বনু আওস, বনু সা'লাবা ও বনু শুতাইবার ইহুদীদের অধিকার বনু আওফের ইহুদীদের সমান।
- সালাবার যাবতীয় বাহ্যিক ব্যাপার তাদের ভেতরকার ব্যাপারের সমপর্যায়ে তাদের প্রাণের মতই সম্মাননার।
- আনুগত্য ও প্রতিশ্রুতিপরায়ণতা যেন সবাইকে পাপাচার থেকে রক্ষা করে।
- সালাবার মিত্রদের অধিকার তাদের নিজেদেরই সমান।
- ইহুদীদের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার তাদের প্রাণের মতই সম্মাননার।
- তাদের ভেতর থেকে কেউ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুমতি ছাড়া মদীনার বাইরে যেতে পারবে না।
- যে ব্যক্তি কাউকে হত্যা করলো সে নিজের ও নিজের পরিবার পরিজনের ধ্বংসের বিনিময়েই হত্যা করলো। অবশ্য নিহত ব্যক্তি অপরাধী হলে আলাদা কথা। আল্লাহ তায়ালা এ ক্ষেত্রে অধিকতর মহানুভবতা পছন্দ করেন।
- ইহুদীদের ব্যয়ভার তারা নিজেরাই বহন করবে এবং মুসলমানদের ব্যয়ভারও তারা নিজেরাই বহন করবে।
- এই ঘোষণাপত্রকে যারা মেনে নিয়েছে তাদের কর্তব্য, কোন শরীক যুদ্ধরত থাকলে তাকে সর্বতোভাবে সাহায্য করা এবং পরস্পরের মধ্যে হিতকামনা, সদুপদেশ ও মহানুভবতার সম্পর্ক থাকবে, কোন পাপ কাজে একজন আর একজনের সাথে শরীক হবে না।
- নিজের মিত্রের ক্ষতি সাধন এক ভয়ংকর নজিরহীন অপরাধ।
- মাযলুমকে সাহায্য করা সকলের কর্তব্য।
- মুমিনরা যতদিন যুদ্ধরত থাকবে ততদিন ইহুদীরা তাদেরকে আর্থিক সহযোগিতা দিয়ে যাবে।
- এই ঘোষণাপত্রের শরীকদের জন্য ইয়াসরিবের অভ্যন্তরে ভাগ সম্পূর্ণ নিরাপদ।
- প্রতিবেশী যদি অপরাধী না হয় এবং ক্ষতিকর কাজে লিপ্ত না থেকে থাকে তা হলে তার জান, মাল ও ইজ্জত নিজের জান, মাল ও ইজ্জতের মতই পূর্ণ নিরাপত্তার অধিকারী।
- কারো বাড়ীর ভেতরে বাড়ীর মালিকের অনুমতি ছাড়া প্রবেশ করা যাবে না।
- এই ঘোষণাপত্র গ্রহণকারীদের মধ্যে যে কোন অপ্রীতিকর ঘটনা কিংবা ঝগড়া কলহ ঘটুক না কেন, তার ফায়সালার জন্য আল্লাহ ও মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শরণাপন্ন হতে হবে।
- আল্লাহ সর্বাধিক সতর্কতা ও সততার সাথে এই ঘোষণাপত্রের বাস্তবায়ন দেখতে আগ্রহী।
- জেনে রাখা দরকার যে, কুরাইশ ও তাদের সহযোগীদের আশ্রয় দেয়া চলবে না।
- ঘোষণাপত্র গ্রহণকারীগণ মদীনা আক্রমণকারীকে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ করবে। আর যখন সন্ধি ও মৈত্রী স্থাপনের আহ্বান জানানো হবে তখন তারা আহ্বানকারীর সাথে সন্ধি ও মৈত্রী স্থাপন করবে। এ ধরনের কোন সন্ধি ও মৈত্রীর দিকে তাদেরকে যখন আহ্বান জানানো হবে তখন তা মেনে চলা মুমিনদের জন্যও বাধ্যতামূলক হবে।
- তবে যে বা যারা ধর্মের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হবে তার বা তাদের সাথে কোন সন্ধি বা মৈত্রী হবে না।
- সাধারণ মানুষ যখন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করবে তখন তারা তাদের প্রাপ্য অংশ সেই পক্ষের নিকট থেকে নেবে যে পক্ষ তাদেরকে বাহিনীতে ভর্তি করেছিল। আওসের ইহুদীদের ও তাদের মিত্রদের অধিকার ও দায়দায়িত্ব এই ঘোষণাপত্র গ্রহণকারীদের অধিকার ও দায়দায়িত্বের মতই এবং ঘোষণাপত্র সম্পাদনকারীদের কাছ থেকে তারা পূর্ণ ন্যায়সঙ্গতভাবে তা লাভকরতে পারবে।
- কেউ সততার পথ অবলম্বন করলে তার পূর্বতন পাপাচার ক্ষমার চোখে দেখতে হবে।
- কেউ খারাপ কাজ করলে তা তার নিজেরই ক্ষতি সাধন করবে।
- আল্লাহ এই ঘোষণাপত্রের আনুগত্যের ব্যাপারে সর্বাধিক সততা ও সত্যবাদিতা দেখতে চান। এই ঘোষণাপত্র কোন অত্যাচারী বা অপরাধীর জন্য রক্ষাকবচ নয়।
- যুলুম কিংবা অপরাধে লিপ্ত না হলে যুদ্ধ থেকে বেরিয়ে যাওয়া কিংবা নিষ্ক্রিয় বসে থাকা লোকও মদীনার চৌহদ্দির ভেতরে নিরাপত্তা লাভ করবে।
- যে ব্যক্তি সততা ও খোদাভীতির পথে অবিচল থাকবে, আল্লাহ ও মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার আশ্রয়দাতা ও সহায়ক থাকবেন।
মদিনা সনদ এর গুরুত্ব
পৃথিবীর ইতিহাসে এবং ইসলামের ইতিহাসে মদিনা সনদের গুরুত্ব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এ সনদের মাধ্যমে মূলত মুসলমানদের নতুন যুগের শুরু হয়। প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নবগঠিত মদিনা রাষ্ট্রের অঘোষিত রাষ্ট্র
প্রধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
এই সনদ এর উপর ভিত্তি করে পরবর্তীতে গঠিত হয় জগৎবিখ্যাত মুসলিম সাম্রাজ্য। এই
সনদের মাধ্যমে মুসলিমদের যে শাসন কার্যক্রম শুরু হয় তা পরবর্তী ১৩০০ বছর পর্যন্ত
চলমান থাকে এবং মুসলিমরা অর্ধ পৃথিবী ব্যাপী তাদের শাসন কার্য প্রতিষ্ঠা
করতে সক্ষম হয়।
তৎকালীন ইয়াসরিবের বাসিন্দারা বিভিন্ন গোত্রে বিভক্ত হয় এক গোত্র অপর গোত্রের
সাথে সর্বদা যুদ্ধ বিবাদে লিপ্ত থাকতো। তাদের মধ্যে পারস্পরিক সৌহার্দ্যপূর্ণ
সম্পর্ক তৈরির জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এবং
মরুর ইয়াসরিব সোনার মদিনায় পরিণত হয়।
সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয়, অর্থনৈতিক, আন্তর্জাতিক এবং বিচারিক ব্যবস্থা
সম্পর্কে এই সনদে সুস্পষ্ট এবং সুনির্দিষ্ট ধারণা প্রদান করা হয়। যার কারণে এই
সনদ খুব দ্রুতই কার্যকারিতা লাভ করে এবং সাধারণ মানুষের অধিকার রক্ষায়
গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
মদিনা সনদের ধারা কয়টি - মদিনা সনদ কি : লেখক এর মতামত
আজকে আমরা আপনাদের সামনে মদিনা সনদ কি ? , মদিনা সনদের ধারা কয়টি , মদিনা সনদ কত
সালে লিখিত হয় এবং মদিনা সনদ এর গুরুত্ব সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করলাম।
এ সংক্রান্ত আপনাদের যেকোনো মতামত বা প্রশ্ন থাকলে আমাদের কমেন্ট বক্সে কমেন্ট
করে জানাতে পারেন। এরকম প্রয়োজনীয় আরও তথ্য পেতে নিয়মিত আমাদের ওয়েবসাইটটি
ভিজিট করুন এবং আমাদের ফেসবুক পেজটিতে ফলো দিয়ে রাখুন। ধন্যবাদ।।
Source:
Madina Charter